গাজায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মধ্যেও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নতুন বোমাবর্ষণে অন্তত ২৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বুধবার ভোরে চালানো এসব হামলায় আরও ৭৭ জন আহত হয়েছে। আল জাজিরার স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, এটি যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির অন্যতম বড় লঙ্ঘন।
আল জাজিরার গাজা সিটি প্রতিনিধি হানি মাহমুদ জানান, দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি এলাকা, গাজা সিটির শুজাইয়া মোড় এবং জেইতুন অঞ্চলে একটি আবাসিক ভবনকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। জেইতুনে একটি পরিবারসহ কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়।“যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজায় প্রতিদিন আতঙ্ক বাড়ছে,” বলেন মাহমুদ।
ইসরায়েল দাবি করেছে, খানইউনিসে তাদের অবস্থানে গুলি চালানোর অভিযোগে তারা “হামাসের লক্ষ্যবস্তুতে” প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে হামাস এটি “অযৌক্তিক অজুহাত” বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
রামাল্লাহ থেকে আল জাজিরার নূর ওদেহ জানান, ইসরায়েল নিজেই যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ নির্ধারণ করছে এবং সেই অজুহাতে আক্রমণ চালাচ্ছে।“এটি কার্যত বিচারক, জুরি এবং কার্যকরকারী—সব ভূমিকাই তারা নিজেদের হাতে নিয়েছে,” মন্তব্য ওদেহের।
এসব হামলা এমন সময় বাড়ছে যখন লেবাননেও ইসরায়েলি হামলা তীব্রতর হয়েছে। পূর্বদিন লেবাননের একটি ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বোমায় ১৩ জন নিহত হয়।
সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত গাজা ‘স্থিতিশীলতা বাহিনী’ এবং নতুন শাসন কাঠামোর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পরিকল্পনা এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিনি দলগুলো এই পরিকল্পনাকে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক কুইন্সি ইনস্টিটিউটের ফেলো খালেদ এলগিন্দি বলেন, “ইসরায়েলের ধারাবাহিক হামলা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।”
গাজায় সঙ্কট চলমান অবস্থায় পশ্চিম তীরে মানবিক পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে। ইসরায়েলের ‘আয়রন ওয়াল’ অভিযান শুরুর ১০ মাস পরও নুর শামস, তুলকারেম ও জেনিন শরণার্থী শিবিরের ৩০,০০০-এর বেশি মানুষ ঘরে ফিরতে পারেননি। বাস্তুহারা এসব মানুষ সম্প্রতি বিক্ষোভ শুরু করেছে। প্রতিবাদ কভার করার সময় আল জাজিরার ক্যামেরাম্যান গুলিবিদ্ধ হন।
ডাক্তারস উইদাউট বর্ডারস (MSF) জানিয়েছে, এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সংকট দেখা দিয়েছে—ধারাবাহিক সহিংসতা, বাসস্থান হারানো এবং অনিশ্চয়তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। MSF বলছে, অনেক পরিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাস বা অপূর্ণ নির্মাণাধীন ভবনে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করছে, যেখানে রোগ ও মানসিক চাপ বাড়ছে।
UNRWA এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি নীতি বাস্তুচ্যুতিকে স্থায়ী করে তুলছে এবং “জাতিগত নিধনের ঝুঁকি”তৈরি করছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংযুক্ত করার দাবি জোরালো করছে, যা ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করছে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও স্থায়ী শান্তি এখনও অনিশ্চিত। গাজায় ৩৯৩টিরও বেশি যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হওয়া এবং পশ্চিম তীরে ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি সংকট—উভয়ই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ফিলিস্তিনের দুই ভূখণ্ডে পরিস্থিতি একই সূত্রে বাঁধা। মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, গাজার ভবিষ্যৎ এবং পশ্চিম তীরের ভবিষ্যৎ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত—এক অঞ্চলে শান্তি আর অন্য অঞ্চলে দমন-পীড়ন একসঙ্গে চলতে পারে না।



