টানা ২৫ বছর ধরে একটানা মানুষ বসবাস করছে পৃথিবীর কক্ষপথে— এমন অভূতপূর্ব সাফল্য উদযাপন করছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS)। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর প্রথমবারের মতো মানুষ এই মহাকাশ ঘাঁটির দরজা খুলেছিল। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও এটি জনশূন্য হয়নি।
৫টি মহাকাশ সংস্থা নাসা, রাশিয়ার রসকসমস, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ESA), জাপানের জাক্সা এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এই মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবীর প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উপরে কক্ষপথে ঘুরছে ঘণ্টায় ২৮,০০০ কিলোমিটার গতিতে। প্রতি ৯০ মিনিটে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এটি, অর্থাৎ দিনে ১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায় এখান থেকে।
২০০০ সালের ৩১ অক্টোবর রাশিয়ার কাজাখস্তান ঘাঁটি থেকে সোয়ুজ রকেটে যাত্রা শুরু করেন প্রথম তিন মহাকাশবাসী— নাসার বিল শেফার্ড এবং রাশিয়ার সের্গেই ক্রিকালেভ ও ইউরি গিদজেঙ্কো। তারা পাঁচ মাস সেখানে অবস্থান করে স্টেশনটিকে কার্যকর ও বাসযোগ্য করে তোলেন।
নাসার হিসাবে, এ পর্যন্ত ২৬টি দেশের ২৯০ জন মহাকাশযাত্রী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অবস্থান করেছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মহাকাশ পর্যটক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এমনকি ব্যবসায়ীরাও। প্রথম পর্যটক ছিলেন মার্কিন উদ্যোক্তা ডেনিস টিটো, যিনি ২০০১ সালে নিজ খরচে রাশিয়ার মাধ্যমে সেখানে যান।
দীর্ঘ এই অভিযাত্রায় মহাকাশ স্টেশনকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। স্পেসওয়াকের সময় প্রায় ডুবে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা, ডকিং ত্রুটিতে স্টেশনের ঘূর্ণন, ক্ষুদ্র ফাটল থেকে বাতাসের লিক— এসব ঘটনাও ঘটেছে। তবুও এটি এখনো কর্মক্ষম, যা প্রকৌশলীদের কাছে এক বিস্ময়।
প্রথম দিকের সীমিত সুবিধা পেরিয়ে এখন ISS যেন এক বিলাসবহুল “চার তারকা হোটেল”। রয়েছে ছয়টি ঘুমের কক্ষ, দুইটি বাথরুম, একটি জিম এবং পৃথিবীর ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্যের জানালা ‘কাপোলা’। এখানে এমনকি কফি মেশিন ও কুকি ওভেনও পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে!
এখানে অবস্থানরত অবস্থায় কেউ কেউ সন্তানের জন্মের খবর পেয়েছেন, আবার কেউ শোকও পেয়েছেন। মহাকাশে থেকেও পরিবারের সঙ্গে ভিডিও কলে যুক্ত হয়েছেন অনেকে।
ISS-এ প্রায় ৩,০০০টিরও বেশি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। শূন্য মাধ্যাকর্ষণে মানবদেহে কী প্রভাব পড়ে, তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। উদ্ভিদ জন্মানো, কোষ ও ডিএনএ-র আচরণ, এমনকি মহাকাশে রক্তজমাট বাঁধার চিকিৎসা— এসব নিয়েও গবেষণা চলছে। “আলফা ম্যাগনেটিক স্পেকট্রোমিটার” নামের এক বিশেষ যন্ত্র মহাজাগতিক কণার উৎস অনুসন্ধান করছে।
মহাকাশ স্টেশনটির দৈর্ঘ্য ৩৫৬ ফুট— অর্থাৎ একটি ফুটবল মাঠের প্রায় সমান। ৮টি সৌর প্যানেল থেকে এটি ৯০ কিলোওয়াট পর্যন্ত শক্তি উৎপাদন করে। এতে রয়েছে ৩৫,০০০ ঘনফুট বায়ুচাপযুক্ত স্থান এবং ৫০টিরও বেশি কম্পিউটার।
ISS-কে ২০৩১ সালে অবসরে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে নাসা। তখন এটি স্পেসএক্স-এর বিশেষ ক্যাপসুলের মাধ্যমে নিরাপদে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে ধ্বংস করা হবে। এরই মধ্যে অ্যাক্সিয়ম স্পেস ও অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নতুন বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন তৈরির কাজ শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন শুধু বৈজ্ঞানিক সাফল্য নয়, এটি মানব ঐক্যের প্রতীকও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ একসঙ্গে কাজ করছে মহাকাশে— ভবিষ্যতের চাঁদ ও মঙ্গল অভিযানের পথ প্রশস্ত করেই চলছে এই “ভাসমান ল্যাবরেটরি”।



