যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া ২৮ দফা ইউক্রেন শান্তি পরিকল্পনার জবাবে ইউরোপের তিন শক্তি—ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি—একটি পাল্টা প্রস্তাব তৈরি করেছে, যার পূর্ণাঙ্গ টেক্সট রবিবার রয়টার্সের হাতে আসে। ইউরোপের এই “E3” দেশগুলোর করা পাল্টা প্রস্তাবটি মার্কিন খসড়াকে ভিত্তি করে প্রতিটি পয়েন্টে সংশোধন, পরিবর্তন ও বাদ দেওয়ার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে।
সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা বিষয়ক মূল প্রস্তাব-
প্রস্তাবের শুরুতেই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব পুনরায় নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। রাশিয়া, ইউক্রেন ও ন্যাটোর মধ্যে সম্পূর্ণ ও সুস্পষ্ট অ-আগ্রাসন চুক্তির আহ্বান জানানো হয়েছে, যা গত তিন দশকের নিরাপত্তা সংশয় দূর করবে।
মার্কিন পরিকল্পনার তৃতীয় পয়েন্ট—রাশিয়া প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করবে না এবং ন্যাটো সম্প্রসারণ বন্ধ থাকবে—E3 এটি বাদ দিয়েছে।
নিরাপত্তা ও ন্যাটো সম্পর্ক-
শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে নিরাপত্তা উদ্বেগ ও উত্তেজনা কমাতে সংলাপ চালুর কথা বলা হয়েছে। ইউক্রেনকে “মজবুত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা” দেওয়ার পাশাপাশি তার সেনাবাহিনীর আকার শান্তিকালে ৮ লাখে সীমাবদ্ধ করার প্রস্তাব রয়েছে।
ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ ন্যাটোর সর্বসম্মতির ওপর নির্ভর করবে—বর্তমানে যার অভাব রয়েছে। এছাড়া ন্যাটো ইউক্রেনে স্থায়ীভাবে সৈন্য মোতায়েন করবে না এবং যুদ্ধবিমান পোল্যান্ডে রাখা হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য আর্টিকল–৫–এর সমতুল্য নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে, তবে এর জন্য ক্ষতিপূরণ নেবে এবং ইউক্রেন যদি রাশিয়ায় হামলা চালায়, তবে সেই নিশ্চয়তা বাতিল হবে।
পুনর্গঠন, অর্থনীতি ও ইউরোপীয় সংযুক্তি-
ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের যোগদানের সম্ভাবনা উন্মুক্ত রাখা হয়েছে এবং স্বল্পমেয়াদি সুবিধাপ্রাপ্ত বাজার প্রবেশাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। পাশাপাশি প্রযুক্তি, অবকাঠামো, খনিজ সম্পদ, গ্যাস অবকাঠামোসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল পুনর্গঠনে একটি বিশাল গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট প্যাকেজ ঘোষণার কথা বলা হয়েছে।
রাশিয়াকেও ধাপে ধাপে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পুনঃএকীভূত করার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে—ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি এবং G8-এ পুনরায় অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনাসহ।
তবে প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—ইউক্রেন পুনর্গঠন ও ক্ষতিপূরণের জন্য রাশিয়ার সার্বভৌম সম্পদ জমাট রাখা হবে, যতক্ষণ না মস্কো ক্ষতি–ক্ষয় পূরণ করে।
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ ও মানবাধিকার-
রাশিয়া–যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। ইউক্রেনকে অ-পরমাণু রাষ্ট্র হিসেবে থাকা বাধ্যতামূলক থাকবে। জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্র পুনরায় চালু করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ রাশিয়া–ইউক্রেন সমান ভাগে ভাগ করবে—আইএইএ এর তত্ত্বাবধানে।
ইউক্রেনে ধর্মীয় সহনশীলতা ও ভাষাগত সংখ্যালঘু সুরক্ষায় ইউরোপীয় মানদণ্ড গ্রহণের প্রস্তাব রয়েছে।
ভূখণ্ড সংক্রান্ত বিতর্কিত অংশ-
সবচেয়ে বিতর্কিত অংশে বলা হয়েছে—ইউক্রেন সামরিক উপায়ে দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধার করবে না। ভবিষ্যৎ ভূখণ্ড বিনিময় বা সমন্বয়ের আলোচনা বর্তমান “লাইন অব কন্ট্যাক্ট” থেকে শুরু হবে। ভবিষ্যৎ সীমানা নির্ধারণের পর দুই পক্ষই তা বলপ্রয়োগে পরিবর্তন না করার অঙ্গীকার দেবে, এবং এ নিয়ম ভাঙলে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা কার্যকর হবে না।
মানবিক বিষয়ক উদ্যোগ-
একটি মানবিক কমিটি গঠন করে বন্দি বিনিময়, বেসামরিক আটক মুক্তি, শিশুদের ফেরত পাঠানো, পরিবার পুনর্মিলন এবং যুদ্ধ–ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নির্বাচন, পর্যবেক্ষণ ও যুদ্ধবিরতি-
চুক্তি স্বাক্ষরের পর যত দ্রুত সম্ভব ইউক্রেনে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হয়েছে। পুরো চুক্তির বাস্তবায়ন তত্ত্বাবধান করবে “বোর্ড অব পিস”—যার চেয়ারম্যান হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চুক্তি লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে।
সমস্ত পক্ষ প্রস্তাবে সম্মতি দিলে তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি উভয় পক্ষ চুক্তি বাস্তবায়নের নির্ধারিত অবস্থানে সরে যাবে। যুদ্ধবিরতির পর্যবেক্ষণ যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে।



